আদর্শ জীবনচরিত (পঞ্চম অধ্যায়)

ষষ্ঠ শ্রেণি (মাধ্যমিক) - ইসলাম শিক্ষা | NCTB BOOK
163

আদর্শ জীবন বলতে বোঝায় যে জীবন অনুসরণ করলে জীবন সুন্দর ও সুগঠিত হয়। পৃথিবীতে এমন অনেক মহৎ ব্যক্তির আবির্ভাব ঘটেছে যাঁদের জীবনচরিত অন্যের জন্য আদর্শ। সুতরাং বাস্তব জীবনে এসব মনীষীর সমাজসেবামূলক কাজ, অসাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গি, আত্মত্যাগ, ক্ষমা, পরমতসহিষ্ণুতা ও দেশপ্রেমসহ অন্যান্য গুণ অনুসরণ ও অনুকরণ করলে সুন্দর সুশৃঙ্খল ও সফল জীবন লাভ করা যায়।

এ অধ্যায় শেষে আমরা-

  • আদর্শ জীবনচরিতের ধারণা ব্যাখ্যা করতে পারব।
  • মহানবি (স.)-এর পরিচয়, সততা, বিশ্বস্ততা, সমাজসেবা, শান্তি প্রতিষ্ঠা ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ও তাঁর অন্যান্য চারিত্রিক গুণাবলি বর্ণনা করতে পারব।
  • পরিচয়সহ হযরত আবু বকর (রা.)-এর দানশীলতা, ত্যাগ ও সুশাসন প্রতিষ্ঠায় তাঁর অবদান বর্ণনা করতে পারব।
  • সাম্য, গণতান্ত্রিক চেতনাবোধ, দেশপ্রেম ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় হযরত উমর ফারুক (রা.)-এর অবদান উল্লেখ করতে পারব।
  • হযরত খাদিজা (রা.)-এর পরিচয়, দানশীলতা, সহমর্মিতাসহ তাঁর চারিত্রিক মাধুর্য ও শ্রেষ্ঠত্ব বর্ণনা করতে পারব।
  • হযরত ইমাম আবু হানিফা (র.)-এর পরিচয়, ফিকাহশাস্ত্রে তাঁর আবদান বর্ণনা করতে পারব।
  • হযরত আব্দুল কাদির জিলানী (র.)-এর পরিচয়, মানবপ্রেমসহ তাঁর চরিত্রের মহৎ গুণাবলি ব্যাখ্যা করতে পারব।
Content added By

# বহুনির্বাচনী প্রশ্ন

উদ্দীপকটি পড় এবং প্রশ্নের উত্তর দাও

মক্কার কাফিরদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে মহানবি (স.) আল্লাহ তায়ালার হুকুমে মক্কা ছেড়ে মদিনায় হিযরত করেন।

উদ্দীপকটি পড় এবং প্রশ্নের উত্তর দাও

যাওয়াদ সব সময় বড়দের সম্মান ও ছোটদের স্নেহ করে। তার এ আচরণের জন্য তাকে সবাই পছন্দ করে।

উদ্দীপকটি পড় এবং প্রশ্নের উত্তর দাও

যে সরকার জনগণের দ্বারা পরিচালিত ও জনকল্যাণমূলক, তাকে গণতান্ত্রিক সরকার বলা হয়। হযরত উমর (রা.) ছিলেন গণতন্ত্রমনা। এজন্য সবাই তাঁকে ভালোবাসতেন।

হযরত মুহাম্মদ (স.)-এর জীবনাদর্শ (পাঠ ১)

107

আরবের অবস্থা
হযরত মুহাম্মদ (স.)-এর জন্মের সময় আরবের সামাজিক অবস্থা ছিল ভয়াবহ ও জঘন্য। আরবের লোকেরা ছিল নানা পাপে লিপ্ত। মারামারি, কাটাকাটি, ঝগড়া-বিবাদ, চুরি, ডাকাতি, হত্যা, লুণ্ঠন, দুর্নীতি ও অরাজকতা করে তাদের জীবন চলত। তারা এক আল্লাহর পরিবর্তে বিভিন্ন দেব-দেবীর পূজা করত। সমগ্র আরবদেশ বর্বরতা ও প্রকৃতি পুজায় নিমজ্জিত ছিল। কাব্যচর্চা, গান ও বাগ্মীতায় অগ্রসর থাকলেও নৈতিক চরিত্রে আরব সমাজ পিছিয়ে পড়েছিল। হাটে-বাজারে পণ্যের মতো মানুষ বেচাকেনা হতো। এদের জীবন-মৃত্যু মনিবের খেয়ালখুশির উপর নির্ভর করত। মনিবরা এদের প্রতি অমানুষিক নির্যাতন চালাত। ব্যতিক্রম ছাড়া সাধারণভাবে নারীদের অবস্থা ছিল খুবই করুণ। নারীদের কোনো সামাজিক মর্যাদা বা অধিকার ছিল না। এমনকি সে সময় জীবন্ত মেয়ে শিশুদের গর্তে ফেলে মাটি চাপা দেওয়া হতো। এরূপ অবস্থায় আল্লাহ তায়ালা মানুষকে সঠিক পথে পরিচালনা করার জন্য হযরত মুহাম্মদ (স.)-কে পাঠান। তাঁর আগেও পৃথিবীতে আরও অনেক নবি-রাসুল এসেছেন। আমাদের নবি হলেন সর্বশেষ নবি। সকল নবির সেরা নবি, বিশ্বনবি।

জন্ম ও পরিচয়
হযরত মুহাম্মদ (স.) আমাদের প্রিয় নবি। তিনি ৫৭০ খ্রিষ্টাব্দের ২০শে এপ্রিল রবিউল আউয়াল মাসের ১২ তারিখ সোমবার মক্কায় জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম আব্দুল্লাহ এবং মাতার নাম আমিনা। তিনি মাতৃগর্ভে থাকতেই তাঁর পিতা আব্দুল্লাহ মৃত্যুবরণ করেন। জন্মগ্রহণের পর তাঁর নাম রাখা হয় মুহাম্মদ ও আহমাদ।
মহানবির চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য ও পাদ্রি বুহাইরার ভবিষ্যদ্বাণী
আরবদের বনু সা'দ গোত্রের মেয়ে ধাত্রী হালিমার উপর শিশু মুহাম্মদের লালনপালনের দায়িত্ব পড়ে। তিনি পাঁচ বছর বয়স পর্যন্ত তাঁকে নিজের সন্তানের মতো স্নেহ-মমতায় লালনপালন করেন। এরপর মুহাম্মদ (স.) মা আমিনার কোলে ফিরে আসেন। তিনি মা আমিনার সীমাহীন আদরযত্নে বড় হতে লাগলেন। কিন্তু তাঁর কপালে এ আদরও বেশিদিন জুটল না। তাঁর মাও মৃত্যুবরণ করেন। তখন তাঁর বয়স ছিল মাত্র ছয় বছর। অল্প বয়সেই তিনি পিতামাতা উভয়কে হারিয়ে ইয়াতিম হয়ে যান। বিশ্বের বুকে তিনি তখন একা, নিঃসঙ্গ ও অসহায় বালক। উম্মে আয়মান নামক একজন পরিচারিকা তাঁকে দাদা আব্দুল মুত্তালিবের হাতে তুলে দেন। দাদা অত্যন্ত আদরযত্নে তাঁকে লালনপালন করতে থাকেন। তাঁর বয়স যখন আট বছর তখন দাদাও তাঁকে ছেড়ে পরলোকগমন করেন। এবার তিনি চাচা আবু তালিবের হাতে বড় হতে থাকেন। চাচার সংসারে ছিল অভাব-অনটন। তিনি চাচার ব্যবসায়িক কাজে সহযোগিতা করতেন ও মেষ চরাতেন। চারিত্রিক সকল ভালো গুণ তাঁর মধ্যে পরিলক্ষিত হয়। তিনি অহংকার, অপব্যয়, অর্থহীন ও অনৈতিক কথা থেকে নিজেকে মুক্ত রাখতেন এবং তিনি অন্যের দোষ খোঁজা ও কাউকে লজ্জা দেওয়া থেকেও বিরত থাকতেন। সর্বদা মানুষের সাথে হাশিখুশি কথা বলতেন। অন্যের ব্যথায় ব্যথিত হতেন। মানবতার কল্যাণে নিজের সম্পদ অকাতরে ব্যয় করতেন। তিনি ছিলেন সত্যবাদী। তাঁকে আপন-পর সকলেই আল-আমিন (বিশ্বাসী) উপাধিতে ভূষিত করেন। এক কথায় তিনি পৃথিবীর সকল প্রাণী ও জীবজন্তুর উপকারী বন্ধু ছিলেন।
হযরত মুহাম্মদ (স.)-এর বয়স যখন ১২ বছর ২ মাস ১০ দিন তখন চাচা আবু তালিবের সাথে ব্যবসার উদ্দেশ্যে সিরিয়া রওয়ানা হলেন। তিনি বসরায় পৌঁছলে বুহাইরা (জারজিস) নামক একজন খ্রিষ্টান পাদ্রির সাথে দেখা হয়। তিনি মুহাম্মদ (স.)-কে চিনতে পেরে বলেন, ইনিই শেষ জামানার নবি ও সর্বশ্রেষ্ঠ রাসুল। পাদ্রি আবু তালিবকে বলেন, ওকে মক্কায় ফেরত পাঠিয়ে দেন, ইহুদিরা তাঁর ক্ষতি করতে পারে। এ পরামর্শ অনুযায়ী চাচা আবু তালিব কয়েকজন ভৃত্যের সঙ্গে প্রিয় ভাতিজাকে মক্কায় পাঠিয়ে দেন।

শান্তি প্রতিষ্ঠায় মহানবি (স.)
ওকাজ মেলায় জুয়া খেলাকে কেন্দ্র করে ফিজার যুদ্ধ শুরু হয়। তা একটানা পাঁচ বছর চলতে থাকে। এতে অনেক লোকের প্রাণহানি ঘটে। মহানবি (স.) এসব হানাহানি ও রক্তারক্তি অবস্থা দেখে ব্যথিত হলেন। কীভাবে শান্তি প্রতিষ্ঠা করা যায়, তা নিয়ে চিন্তা করতে লাগলেন। অবশেষে তিনি শান্তিকামী কয়েকজন যুবককে নিয়ে 'হিলফুল ফুযুল' নামে একটি শান্তিসংঘ গঠন করেন। এর মাধ্যমে তিনি তৎকালীন আরবের চলমান হিংসা-বিদ্বেষ, মারামারি ও হানাহানি বন্ধ করতে আপ্রাণ চেষ্টা করেন। তাঁর এ প্রচেষ্টার ফলে সমাজে কিছুটা শান্তি ফিরে আসে। সকল মানুষের মধ্যে পারস্পরিক ভ্রাতৃত্ব ও গোত্রে গোত্রে সম্প্রীতি সৃষ্টি হয় এবং তাঁর সুখ্যাতি চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। ফলে আপন-পর সকলেই তাঁকে আল-আমিন (বিশ্বাসী) উপাধিতে ভূষিত করেন।

কুরাইশগণ বহুদিনের পুরাতন কাবা ঘর সংস্কারের কাজ হাতে নিল। কাবা ঘর সংস্কারের কাজ সমাপ্ত হলো। কিন্তু পবিত্র হাজরে আসওয়াদ (কালো পাথর) স্থাপন করা নিয়ে তাঁদের মধ্যে ঝগড়ার সৃষ্টি হলো। এ ঝগড়া বিভিন্ন গোত্রে ছড়িয়ে পড়ল। প্রত্যেকেই এ পাথর স্থাপনের মতো মহৎ কাজের অংশীদার হতে চাইল। কেউ ছাড় দিতে রাজি হলো না। তাই গোত্রসমূহের মধ্যে যুদ্ধের প্রস্তুতি শুরু হলো। অবশেষে সিদ্ধান্ত হলো আগামী দিন সকালবেলা সবার আগে যিনি কাবা ঘরে প্রবেশ করবেন তিনিই এ বিবাদ মীমাংসা করবেন। তিনি যা সিদ্ধান্ত দেবেন সকলেই তা মেনে নেবে। সকালবেলা দেখা গেল হযরত মুহাম্মদ (স.) সবার আগে কাবা ঘরে প্রবেশ করেছেন। এটা দেখে সকলেই আনন্দ প্রকাশ করল এবং বলে উঠল, 'আল-আমিন এসেছেন, সঠিক সিদ্ধান্ত হবে।' হযরত মুহাম্মদ (স.) একখানা চাদর বিছিয়ে নিজ হাতে পাথরটি চাদরের মাঝখানে রাখলেন। তারপর সকল গোত্রের সরদারকে ডেকে চাদর ধরতে বললেন। তারা সকলে মিলে চাদরটি বহন করে যথাস্থানে নিয়ে গেল, হযরত মুহাম্মদ (স.) নিজ হাতে পাথরখানা কাবার দেয়ালে বসিয়ে দিলেন। ফলে জাতি একটি ভয়াবহ যুদ্ধ হতে বেঁচে গেল এবং সকলে পাথরটি বহনের সম্মান পেয়ে খুশি হলেন।

নবুয়তপ্রাপ্তি ও আরবের লোকদের প্রতিক্রিয়া
হযরত মুহাম্মদ (স.) শৈশবকাল হতেই মানুষের মুক্তি ও শান্তির কথা ভাবতেন। যুবক বয়সে তাঁর এ ভাবনা আরও গভীর হতে থাকে। হযরত খাদিজা (রা.)-এর সাথে বিবাহের পর তিনি সাধনা ও ধ্যান আরও বাড়িয়ে দেন। তিনি মক্কার অদূরে হেরা গুহায় গভীর ধ্যানে মগ্ন থাকতেন। তিনি সর্বদা চিন্তা করতেন, কীভাবে মানবজাতিকে মূর্তিপূজা, অগ্নিপূজা ও শিরক হতে মুক্ত করবেন ও এক আল্লাহর পথে নিয়ে আসবেন। এভাবে তিনি হেরা গুহায় প্রায় ১৫ বছর ধ্যানমগ্ন থাকেন। মাঝে মাঝে বাড়ি আসতেন, অবার হেরা গুহায় গিয়ে ধ্যানে মগ্ন হতেন। অবশেষে ৪০ বছর বয়সে ৬১০ খ্রিষ্টাব্দে পবিত্র রমযান মাসের ২৭ তারিখ নবুয়ত লাভ করেন।

নবুয়ত লাভের পর তিনি লোকদের এক আল্লাহর প্রতি দাওয়াত দেন। মক্কার কাফিররা তাতে বাধা দেয়। তাই তিনি গোপনে ইসলামের পথে দাওয়াতের কাজ চালিয়ে যান। আরবের প্রভাবশালী মহল সবসময় তাঁর কাজের বিরোধিতা করতে থাকে। তারা হযরত মুহাম্মদ (স.) ও তাঁর অনুসারিদের নানাভাবে নির্যাতন করতে থাকে। হযরত মুহাম্মদ (স.) অত্যন্ত ধৈর্যসহকারে তাদের অত্যাচার সহ্য করেন এবং নীরবে এক আল্লাহর আনুগত্য ও ইবাদতের প্রতি মানুষকে আহবান করতে থাকেন। হযরত মুহাম্মদ (স.) আরব সমাজের কুসংস্কার দূর করে সমাজে শান্তি প্রতিষ্ঠা করেন।

Content added By

হযরত আবু বকর (রা.)-এর জীবনাদর্শ (পাঠ ২)

171

পরিচয়
হযরত আবু বকর (রা.) ছিলেন ইসলামের প্রথম খলিফা। তিনি মক্কার প্রসিদ্ধ কুরাইশ বংশের তায়িম গোত্রে ৫৭৩ খ্রিষ্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাল্য নাম আব্দুল্লাহ, উপাধি সিদ্দিক ও আতিক। পিতার নাম উসমান, ডাকনাম আবু কুহাফা এবং মাতার নাম সালমা, ডাকনাম উম্মুল খায়ের। তাঁরা হযরত মুহাম্মদ (স.)- এর হাতে ইসলাম গ্রহণ করেন। হযরত আবু বকর (রা.) ছিলেন বয়সের দিক থেকে হযরত মুহাম্মদ (স.)- এর চেয়ে তিন বছরের ছোট। মহানবি (স.)-এর প্রায় সমবয়সী হওয়ায় হযরত আবু বকর (রা.)-এর সাথে তাঁর গভীর বন্ধুত্ব ছিল। তিনি উম্মুল মুমিনিন হযরত আয়েশা (রা.)-এর পিতা ও হযরত মুহাম্মদ (স.)-এর শ্বশুর।
ইসলাম গ্রহণ
পুরুষদের মধ্যে সর্বপ্রথম ইসলাম গ্রহণ করেন হযরত আবু বকর (রা.)। তিনি রাসুল (স.)-কে খুব বিশ্বাস করতেন। একদা তিনি ব্যবসার উদ্দেশ্যে ইয়ামেনে গমন করেন। মক্কায় ফিরে শুনলেন হযরত মুহাম্মদ (স.) নবি দাবি করছেন এবং ইসলাম ধর্ম প্রচার করছেন। তিনি রাসুল (স.)-এর দরবারে হাজির হয়ে কালিমায়ে শাহাদাত পাঠ করে ইসলাম গ্রহণ করেন।
চরিত্র ও গুণাবলি
হযরত আবু বকর (রা.) ছিলেন স্বল্পভাষী, সাহসী, ধৈর্যশীল, বিচক্ষণ ও দূরদর্শী। হযরত মুহাম্মদ (স.)-এর প্রতি ছিল তাঁর অটল বিশ্বাস। রাসুল (স.)-এর মে'রাজের (ঊর্ধ্বগমন) ঘটনা অকপটে একমাত্র তিনিই বিশ্বাস করেন। তাই তিনি সিদ্দিক উপাধিতে ভূষিত হন। সততা, ধর্মভিরুতা ও বদান্যতার ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন অদ্বিতীয়। দুঃখী ও আর্তের সেবায় তিনি নিজেকে উৎসর্গ করেন। এজন্য তিনি আরব সমাজে অত্যন্ত প্রভাবশালী ও মর্যাদাবান ব্যক্তি হিসেবে পরিচিত ছিলেন।
তিনি ছিলেন নম্র ও ভদ্র প্রকৃতির লোক। কুরআন পাঠের সময় তাঁর দুই চোখ দিয়ে অশ্রু ঝরতো। ইসলামের সেবায় হযরত আবু বকর সিদ্দিক (রা.)-এর দান অতুলনীয়। তিনি ইসলামের জন্য তাঁর সর্বস্ব বিলিয়ে দিয়েছিলেন। মসজিদে নববি ও হযরত মুহাম্মদ (স.)-এর বাসগৃহ নির্মাণ এবং তাবুক অভিযানে তিনি অর্থ ব্যয় করেন। তিনি হযরত বেলাল (রা.)-সহ অসংখ্য ক্রীতদাসকে ক্রয় করে স্বাধীন ও মুক্ত করে দেন।

ইসলাম প্রচার
ইসলাম গ্রহণের পর হযরত আবু বকর সিদ্দিক (রা.) রাসুল (স.)-এর সঙ্গে ইসলাম প্রচারের কাজে নিয়োজিত হন। মক্কার আশপাশের গোত্রে তিনি ইসলামের দাওয়াত দেন। হজের মৌসুমে বিভিন্ন তাঁবুতে গিয়েও তিনি ইসলামের প্রতি লোকদের আহবান করেন। তাঁর ব্যক্তিগত প্রচেষ্টায় কুরাইশ বংশের বিশিষ্ট যুবক উসমান (রা.), যুবাইর (রা.), আব্দুর রহমান ইবনু আউফ (রা.), সা'দ (রা), জ্বালহা (রা.)-এর মতো আরও অনেক সাহাবি ইসলাম গ্রহণ করেন।

মদিনায় হিজরত
হযরত আবু বকর সিদ্দিক (রা.) হযরত মুহাম্মদ (স.)-এর হিজরতের সাথী ছিলেন। রাসুল (স.) হিজরতের আদেশপ্রাপ্ত হন এবং হযরত আবু বকর সিদ্দিক (রা.)-কে অবগত করেন। তিনি রাসুল (স.) থেকে হিজরতের কথা শুনার পর রাত্রে আর ঘুমাতেন না, অপেক্ষায় থাকতেন কখন রাসুল (স.) এসে তাঁর সাথে হিজরত করার জন্য ডাক দেবেন। গভীর রাত্রে তিনি রাসুল (স.)-এর ডাকে সাড়া দেন এবং উভয়ে হিজরতের উদ্দেশ্যে বের হন। পথিমধ্যে তাঁরা কাফির শত্রুদের হাত থেকে রক্ষা পেতে সাওর নামক পর্বতের গুহায় আশ্রয় নেন। সেখান থেকে মদিনায় হিজরত করেন।
খলিফা নির্বাচন
হযরত মুহাম্মদ (স.)-এর ওফাতের পর হযরত উমর (রা.) ও অন্য সাহাবিগণ হযরত আবু বকর (রা.)- কে খলিফা নির্বাচনের ব্যাপারে পরামর্শ করে তাঁকে ৮ই জুন ৬৩২ খ্রিষ্টাব্দে মুসলিম জাহানের প্রথম খলিফা নির্বাচন করেন। রাসুল (স.)-এর ওফাতের পর মুসলমানদের মধ্যে বিভিন্ন সমস্যার সৃষ্টি হয়। এ সময় কিছু লোক নবি হওয়ার মিথ্যা দাবি করে, আবার কেউ কেউ যাকাত দিতে অস্বীকৃতি জানায়, কেউ কেউ ইসলাম ত্যাগ করে। হযরত আবু বকর সিদ্দিক (রা.) কঠোরভাবে সমস্ত বিশৃঙ্খলা দূর করেন ও শান্তি স্থাপন করেন। তাঁর শাসনামলে ৬৩৩ খ্রিষ্টাব্দে ইয়ামামার যুদ্ধ শুরু হয়। এ যুদ্ধে অনেক হাফিয ও ক্বারি সাহাবি শহিদ হন। এরপর তিনি কুরআন সংরক্ষণ ও সংগ্রহ করার জন্য হযরত যায়েদ ইবনু সাবিত (রা.)- কে নির্দেশ দেন। হযরত যায়েদ ইবনু সাবিত (রা.) আদেশপ্রাপ্ত হয়ে বিভিন্ন সাহাবি থেকে গাছের বাকলে, পশুর হাড় ও চামড়ায় এবং মসৃন পাথরে লিখিত কুরআনের আয়াতসমূহ সংগ্রহ করেন।

ওফাত
হযরত আবু বকর সিদ্দিক (রা.) ২৩শে আগস্ট ৬৩৪ খ্রিষ্টাব্দে ইন্তিকাল করেন। তাঁকে হযরত আয়েশা (রা.)-এর কামরায় হযরত মুহাম্মদ (স.)-এর পাশে মদিনায় সমাহিত করা হয়।
রাসুল (স.)-এর ওফাতের পর হযরত আবু বকর (রা.) ইসলাম রক্ষায় অসাধারণ ভূমিকা পালন করেন। তাঁর আদর্শ সকল মানুষের জন্য অনুসরণীয় ও অনুকরণীয়।

কাজ: শিক্ষার্থীরা শ্রেণিকক্ষে হযরত আবু বকর (রা.)-এর চরিত্রের দুটি গুণ লিখে একটি প্ল্যাকার্ড তৈরি করবে।
Content added By

হযরত উমর ফারুক (রা.)-এর জীবনাদর্শ (পাঠ ৩)

709

পরিচয়
হযরত উমর ফারুক (রা.) ছিলেন মুসলিম জাহানের দ্বিতীয় খলিফা। তিনি ৫৮৩ খ্রিষ্টাব্দে কুরাইশ বংশের আদি গোত্রে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর ডাকনাম আবু হাক্স, পিতার নাম খাত্তাব, মাতার নাম হান্নামা। ইসলাম গ্রহণের পর তিনি ফারুক (সত্য-মিথ্যার পার্থক্যকারী) উপাধিতে ভূষিত হন। বাল্যকালে তিনি উট চরাতেন, যৌবনের শুরুতে যুদ্ধবিদ্যা, কুস্তি, বক্তৃতা ও বংশ তালিকা সম্পর্কে পারদর্শী ছিলেন। হযরত মুহাম্মদ (স.)-এর নবুয়তপ্রাপ্তির সময় কুরাইশ বংশে ১৭ জন ব্যক্তি লেখাপড়া জানতেন, তিনি তাঁদের মধ্যে ছিলেন অন্যতম।

ইসলাম গ্রহণ
হযরত উমর ফারুক (রা.) ইসলাম গ্রহণের আগে আবু জাহালের নেতৃত্বে ইসলামের বিরুদ্ধে অবস্থান নেন। তিনি মুসলমানদের উপর অত্যাচার ও নিপীড়ন চালাতেন। এমনকি তাঁর চাকরানীও ইসলাম গ্রহণ করলে তিনি তার উপর নির্যাতন করা থেকে বিরত থাকেননি। তিনি একবার উন্মুক্ত তলোয়ার হাতে মুহাম্মদ (স.)-কে হত্যার উদ্দেশ্যে বের হন। পথে নঈম ইবনু আব্দুল্লাহর সাথে তাঁর সাক্ষাৎ ঘটে। নঈম বলল, 'কোথায় যাচ্ছ উমর?' উত্তরে রাগস্বরে বললেন, 'মুহাম্মদকে হত্যা করতে যাচ্ছি।' এ কথা শুনে নঈম বলল, 'আগে তোমার ঘর সামলাও। তোমার বোন ফাতিমা ও ভগ্নিপতি সাঈদ ইসলাম গ্রহণ করেছে।' তিনি অগ্নিশর্মা হয়ে বোনের বাড়ি গেলেন। তাঁর বোন ও ভগ্নিপতি তখন পবিত্র কুরআনের সূরা তা-হা পাঠ করছিলেন। এমতাবস্থায় হবরত উমর (রা.)-এর উপস্থিতি তাঁদের মধ্যে ভীতির সঞ্চার করলেও তাঁরা ইমানি চেতনা থেকে সরে যাননি। হযরত উমর (রা.)-এর জিজ্ঞাসাবাদে তাঁরা কুরআন পাঠের কথা জানান। এতে তিনি ক্ষিপ্ত হয়ে তাঁদের উপর আঘাত করতে থাকেন। তখন তাঁর বোনের শরীর থেকে রক্ত ঝরা দেখে তাঁর মনে দয়ার উদ্রেক হয়। হযরত উমর (রা.) তাঁদের বললেন, 'তোমরা কী পাঠ করছিলে তা আমাকে দেখাও।' উত্তরে তাঁর বোন বলল, 'কুরআন পাঠ করছিলাম। এটা পবিত্র গ্রন্থ, অপবিত্র অবস্থায় স্পর্শ করা যায় না।' পরে তিনি পবিত্র হয়ে এলে তাঁকে কুরআন মজিদ পড়তে দেওয়া হয়। তখন তাঁর মনে চিন্তার পরিবর্তন হয়। তিনি তখন ইসলাম গ্রহণের উদ্দেশ্যে রাসুল (স.)-এর নিকট যাওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করেন। সে সময় রাসুল (স.) সাফা পাহাড়ের পাদদেশে হযরত আরকাম (রা.)-এর বাড়িতে অবস্থান করছিলেন। কোষমুক্ত তরবারিসহ হযরত উমর (রা)-এর উপস্থিতি সাহাবিদের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি করে। হযরত উমর (রা.) রাসুল (স.)-এর কাছে কম্পিত কণ্ঠে বললেন, 'হে আল্লাহর নবি! আমাকে ইসলামে দীক্ষিত করুন। যে তরবারি নিয়ে আপনার শিরশ্ছেদের উদ্দেশ্যে বের হয়েছিলাম, আজ হতে সে তরবারি উমরের হাতে ইসলামের শত্রু নিধনে ব্যবহৃত হবে।' হযরত উমর (রা.) হযরত মুহাম্মদ (স.) -এর হাতে তখন ইসলাম গ্রহণ করেন। মূলত তাঁর ইসলাম গ্রহণ ছিল হযরত মুহাম্মদ (স.)-এর দোয়ারই ফল। রাসুল (স.) তাঁর জন্য এভাবে দোয়া করেন, 'হে আল্লাহ! উমর ইবনু হিশাম (আবু জাহাল) অথবা উমর ইবনুল খাত্তাব এ দুইজনের একজনকে ইসলামে প্রবেশ করার তাওফিক দিয়ে ইসলামকে শক্তিশালী করুন।'

খলিফা নির্বাচন
ইসলামের প্রথম খলিফা আবু বকর সিদ্দিক (রা.)-এর ইন্তিকালের পরে তাঁর অন্তিম ইচ্ছা অনুযায়ী হযরত উমর (রা.) ৬৩৪ খ্রিষ্টাব্দে ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা নির্বাচিত হন। তা অধিকাংশ সাহাবি সমর্থন করেন।
শাসনব্যবস্থা
হযরত উমর (রা.) খলিফা নির্বাচিত হওয়ার পর মুসলিম সাম্রাজ্য বিস্তারের ধারাবাহিকতা অব্যাহত থাকে। এ সময় রোম, পারস্য, সিরিয়া, মিসর ও ফিলিস্তিন মুসলিম সাম্রাজ্যভুক্ত হয়। রাজ্য শাসনে তিনি রাসুল (স.)-এর আদর্শ অনুসরণ করতেন। আইনের চোখে সকলকে সমানভাবে দেখতেন। এমনকি মদ্যপানের অপরাধে স্বীয় পুত্র আবু শামাকে শাস্তিদানে বিন্দুমাত্র দ্বিধা করেননি। ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় তিনি ছিলেন যেমন কঠোর তেমনি মানুষের দুঃখকষ্টে তিনি ছিলেন অতি কোমল। তিনি সাধারণ প্রজাদের অবস্থা জানার জন্য রাতের আঁধারে একাকী বের হয়ে পড়তেন। প্রয়োজনে তিনি নিজের কাঁধে খাদ্যসামগ্রী বহন করে গরিব-দুঃখী মানুষের মাঝে বিতরণ করতেন। তাঁর শাসনামলে রাজ্যে কোনো অভাব-অনটন ছিল না। সে সময় কৃষিকাজে ব্যাপক উন্নতি হয়েছিল। তিনি ডাক বিভাগ প্রবর্তন, সাম্য ও ন্যায়ের বাস্তব শাসন প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি হিজরি সন প্রবর্তন করেন। জনকল্যাণে তিনি অসংখ্য মসজিদ, বিদ্যালয়, সেতু, সড়ক, হাসপাতাল নির্মাণ করেন। পানির জন্য তিনি অনেক খালও খনন করেন। তাঁর সময়েই আরবে সর্বপ্রথম আদমশুমারি চালু হয়। ইনসাফ প্রতিষ্ঠায় তিনি বাইতুলমাল থেকে প্রাপ্ত কাপড় সেই পরিমাণ গ্রহণ করতেন যে পরিমাণ সকলের জন্য নির্ধারিত ছিল। তাছাড়া জেরুজালেমে যাওয়ার পথে ভৃত্যকে উটের পিঠে চড়িয়ে নিজে উটের রশি ধরার দৃষ্টান্ত একজন ন্যায়পরায়ণ শাসকের বিরল ঘটনা। ঐতিহাসিক হিট্টি বলেন, 'অল্প কথায় বলা যায়, হযরত উমর (রা.)-এর সরলতা ও কর্তব্যজ্ঞান ছিল তাঁর জীবনাদর্শ। ন্যায়পরায়ণতা ও একনিষ্ঠতা ছিল তাঁর শাসনামলের মূলনীতি।'

চারিত্রিক গুণাবলি
হযরত উমর (রা.) খুব সহজসরল ও অনাড়ম্বর জীবনযাপন করতেন। অর্ধপৃথিবীর শাসক হয়েও তাঁর কোনো দেহরক্ষী ছিল না, খেজুরপাতার আসন ছিল তাঁর সিংহাসন। জনসেবাই ছিল তাঁর ব্রত। ইবাদত বন্দেগিতে অতিবাহিত হতো তাঁর অধিকাংশ সময়। জাগতিক লোভ-লালসা ও জাঁকজমক তাঁকে স্পর্শ করেনি। তাঁর মধ্যে কঠোরতা ও কোমলতার ব্যাপক সমন্বয় ঘটেছিল।

শাহাদতবরণ
হযরত উমর (রা.) তাঁর গৌরবময় শাসনামলের দশম বছরে মসজিদে নববিতে ফজরের নামায আদায় করছিলেন। এমতাবস্থায় কুফার শাসনকর্তা হযরত মুগীরা (রা.) এর ভৃত্য অগ্নিপূজক আবু লুলুর বিষাক্ত ছুরিকাঘাতে আহত হন। তিনি আহত হওয়ার তৃতীয় দিন হিজরি ২৩ সনের ২৭শে জিলহজ বুধবার (৩রা নভেম্বর) ৬৩ বছর বয়সে শাহাদতবরণ করেন। হযরত ইবনু মাসউদ (রা.) বলেন, 'আমার ধারণা হযরত উমর (রা.) যখন দুনিয়া থেকে বিদায় নিয়েছেন, তখন দশভাগ ইলমের নয়ভাগ তিনি সঙ্গে করে নিয়ে গেছেন।' (তাবারানি) আমরা হযরত উমর (রা.)-এর মহান আদর্শ মেনে চলব এবং সে অনুসারে জীবন গড়ব।

কাজ: শিক্ষার্থীরা হযরত উমর (রা.)-এর ন্যায়বিচার ও সুশাসন সম্পর্কে বাড়ির কাজ হিসেবে একটি টীকা লিখে নিয়ে আসবে।
Content added By

হযরত খাদিজা (রা.)-এর জীবনাদর্শ (পাঠ ৪)

173

পরিচয়
মহানবি (স.)-এর প্রথম স্ত্রী হযরত খাদিজা (রা.)। তিনি বিখ্যাত কুরাইশ বংশের আব্দুল উয্য্যা নামক পরিবারে ৫৫৬ খ্রিষ্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা ছিলেন খোয়াইলিদ ইবনে আসাদ আরবের শ্রেষ্ঠ ধনী ব্যক্তি। তাঁর মাতা ফাতিমা বিনতে যায়েদ। বিশ্বের ইতিহাসে যে কয়জন নারী প্রসিদ্ধি লাভ করেছেন, তিনি তাঁদের মধ্যে ছিলেন অন্যতম। সম্পর্কের দিক থেকে তিনি ও রাসুলুল্লাহ (স.) একই বংশের ছিলেন। তাঁর উপাধি ছিল 'তাহিরা' (পুণ্যবতী)। পারিবারিক সূত্রে সম্পদশালিনী বলে তাঁর সুনাম ছিল সমগ্র আরবজুড়ে।
হযরত মুহাম্মদ (স.)-এর সঙ্গে পরিচয় ও বিবাহ
হযরত খাদিজা (রা.) তাঁর ব্যবসা পরিচালনার জন্য বিভিন্ন সময় লোক নিয়োগ করতেন। তিনি মহানবি (স.)-এর সততা, আমানতদারী ও বিশ্বস্ততার কথা শুনে তাঁকে তাঁর ব্যবসা দেখাশোনা করার জন্য অনুরোধ করেন। মহানবি (স.) তাঁর ব্যবসার দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। তিনি তাঁর ব্যবসায়িক কাজে মালামাল নিয়ে সিরিয়ায় গমন করেন। এ ব্যবসায় হযরত খাদিজা (রা.) ব্যাপক লাভবান হন।
হযরত মুহাম্মদ (স.) সিরিয়া থেকে ফেরার পর হযরত খাদিজা (রা.) তাঁর সততা, বিশ্বস্ততা ও উন্নত চরিত্র সম্পর্কে অবগত হন। তিনি যুবক মুহাম্মদ (স)-এর অসাধারণ চরিত্রগুণে মুগ্ধ হয়ে তাঁর সাথে বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপনের প্রস্তাব করেন। হযরত মুহাম্মদ (স)-এর বয়স ছিল তখন ২৫ বছর। আর হযরত খাদিজার বয়স ছিল ৪০ বছর। রাসুল (স.)-এর চাচা আবু তালিবের সম্মতিক্রমে বিশটি উট মোহরের বিনিময়ে এ বিবাহ সম্পন্ন হয়। বিবাহের পর হযরত খাদিজা (রা.) তাঁর সকল সম্পদের দায়দায়িত্ব রাসুল (স.)-এর উপর ছেড়ে দেন এবং নবি করিম (স.)-কে তাঁর ইচ্ছামতো সম্পদ খরচ করার অনুমতি দেন। রাসুল (স.) অকাতরে সম্পদ গরিব-দুঃখীদের মধ্যে দান করেন।
সন্তান-সন্ততি
হযরত মুহাম্মদ (স)-এর সাথে বয়সের ব্যবধান থাকা সত্ত্বেও তাঁদের দাম্পত্য জীবন ছিল অত্যন্ত সুখের। হযরত খাদিজা (রা.)-এর গর্ভে মহানবি (স.)-এর তিন পুত্রসন্তান-কাছিম, আব্দুল্লাহ ও তাহির এবং চার কন্যা-হযরত জয়নাব, রুকাইয়া, উম্মে কুলসুম ও ফাতিমা (রা.) জন্মগ্রহণ করেন। কিন্তু পুত্রগণ শৈশবেই দুনিয়া হতে বিদায় নেন। তাতে নবি করিম (স.) অত্যন্ত মর্মাহত হন।

ইসলাম গ্রহণ
হযরত খাদিজা (রা.) সর্বপ্রথম ইসলাম গ্রহণ করেন। হেরা গুহায় নবুয়তপ্রাপ্ত হয়ে মহানবি (স.) যখন ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে বাড়ি ফিরে ছিলেন তখন হযরত খাদিজা (রা.) স্বীয় স্বামীর অবস্থা বুঝতে পেরে বুদ্ধিমত্তার সাথে তাঁকে এ বলে সান্ত্বনা দেন যে, 'ভীত হওয়ার কিছু নেই, আল্লাহ আপনাকে অপদস্থ করবেন না, কেননা আপনি আত্মীয়দের সাথে সম্পর্ক বজায় রাখেন, দুস্থ অভাবীদের সাহায্য করেন, মেহমানদের আপ্যায়ন করেন এবং ক্ষতিগ্রস্তদের সাহায্য করেন।' এরপর হযরত খাদিজা (রা.) আসমানি কিতাবে অভিজ্ঞ ওয়ারাকা ইবনে নাওফেলের কাছে তাঁকে নিয়ে যান। ওয়ারাকা হেরা গুহায় সংঘটিত ঘটনা শুনে বললেন, 'ভীত হওয়ার কিছু নেই, তিনি সে 'নামুস' (জিবরাইল) যিনি হযরত মুসা (আ.)-এর নিকট প্রেরিত হয়েছিলেন।' পরবর্তীকালে মহানবি (স.) আল্লাহর নির্দেশে ইসলাম প্রচার শুরু করলে হযরত খাদিজা (রা.) সর্বপ্রথম ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। তিনি নবুয়তের দশম বছরে রমযান মাসে ইন্তিকাল করেন। তাঁর মৃত্যুতে নবি করিম (স.) গভীরভাবে শোকাহত হন।

চারিত্রিক গুণাবলি
হযরত খাদিজা (রা.) জাহিলি যুগে জন্মগ্রহণ করেও সৎ চরিত্রের অধিকারিণী ছিলেন। কখনো কোনো অন্যায় ও অশ্লীল কাজে যোগ দেননি। মহানবি (স.)-এর প্রতি ছিল তাঁর প্রবল ভালোবাসা। তিনি ইসলাম প্রচারে হযরত মুহাম্মদ (স.)-কে সাহস ও উৎসাহ প্রদান করতেন। ইসলামের খাতিরে তাঁর সকল সম্পদ দান করার কারণে আল্লাহ তাঁর উপর সন্তুষ্ট ছিলেন। হযরত খাদিজা (রা.)-এর স্বামীভক্তি ছিল অতুলনীয়। যখন রাসুল (স.) বাইরে যেতেন তিনি ফিরে না আসা পর্যন্ত ব্যাকুল হয়ে অপেক্ষা করতেন। আবার তিনি (স.) কখনো বিমর্ষ অবস্থায় বাড়ি ফিরলে হযরত খাদিজা (রা.) তাঁকে সহানুভূতির সাথে সান্ত্বনা দিতেন ও সাহস যোগাতেন।

শ্রেষ্ঠত্ব
মহানবি (স) বলেছেন, 'হযরত খাদিজা (রা.) বিশ্বের শ্রেষ্ঠ নারী।' (বুখারি)। একদা হযরত জিবরাইল (আ.) হযরত খাদিজা (রা.) সম্পর্কে রাসুল (স.)-কে বললেন, 'তাঁর প্রভু (আল্লাহ) এবং আমার পক্ষ থেকে তাঁকে শুভেচ্ছা জানাবেন এবং তাঁকে জান্নাতের সুসংবাদ দেবেন।' (বুখারি ও মুসলিম)। আরও বর্ণিত আছে যে, একদা হযরত আয়েশা (রা.)-এর এক অভিমানের জবাবে রাসুল (স.) বলেন, 'না, আল্লাহ খাদিজার চেয়ে কোনো মহৎ নারী আমাকে দেননি। তিনি এমন সময় আমাকে বিশ্বাস করেছিলেন, যখন সবাই আমাকে মিথ্যাবাদী বলে আখ্যা দিয়েছেন। আমার বিপদের দিনে সবাই যখন আমাকে নিরাশ করেছে তখন তিনি আমাকে অর্থ সাহায্য করেছেন।' (মুসনাদে আহমাদ)। অন্য এক হাদিসে নবি করিম (স.) বলেছেন, 'বিশ্বের সকল নারীর উপর চারজনের সম্মান রয়েছে- হযরত মারিয়াম (আ.), হযরত খাদিজা (রা.), হযরত ফাতিমা (রা.) ও হযরত আসিয়া (আ.)।' বর্তমান বিশ্বের নারীগণ যদি হযরত খাদিজা (রা.)-এর আদর্শ অনুসরণ করে, তাহলে তাদের পারিবারিক ও সামাজিক জীবন অনেক সুন্দর হবে।

কাজ: শিক্ষার্থীরা হযরত খাদিজা (রা.)-এর উত্তম গুণাবলির আলোকে একটি তালিকা তৈরি করবে।
Content added By

হযরত ইমাম আবু হানিফা (র.)-এর জীবনাদর্শ (পাঠ ৫)

113

জন্ম ও পরিচয়
হানাফি মাযহাবের প্রতিষ্ঠাতা ইমাম আবু হানিফা (র.) ৮০ হিজরি ৭০০ খ্রিষ্টাব্দে ইরাকের কুফা নগরীতে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর আসল নাম নোমান, পিতার নাম সাবিত। কিন্তু তিনি আবু হানিফা নামে খ্যাত।
শৈশবকাল
জন্মগতভাবেই ইমাম আবু হানিফা (র.) অসাধারণ মেধার অধিকারী ছিলেন। তিনি অল্প বয়সেই পবিত্র কুরআনের হাফিয হন। তিনি কুরআন, হাদিস ও ফিকাহশাস্ত্রে গভীর জ্ঞান অর্জন করেন। তিনি তৎকালীন মুহাদ্দিস ও ফকিহ হাম্মাদ (র.)-এর কাছে জ্ঞানলাভ করেন। তিনি কাপড়ের ব্যবসা করে জীবন নির্বাহ করতেন।
অবদান
ইমাম আবু হানিফা ছিলেন বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ ফিকাহশাস্ত্রবিদ। মানুষ যাতে সহজ ও সঠিকভাবে শরিয়তের বিষয়গুলো পালন করতে পারে সেজন্য তিনি শ্রেষ্ঠ ফিকাহবিদদের সমন্বয়ে একটি 'ফিকাহ সম্পাদনা পরিষদ' গঠন করেন। তাঁর সম্পাদিত প্রায় তিরাশি হাজার মাসআলা সংবলিত 'কুতুবে হানাফিয়্যা' রচিত হয়। ইমাম আবু হানিফা কুরআন, হাদিস, ইজমা ও কিয়াসের সমন্বয়ে যুক্তিভিত্তিক ও সহজসরল ফিকাহ প্রণয়ন করেন। এ কারণে তাঁর ফিকাহ মুসলমানদের নিকট অতিপ্রিয়। বিশ্বের মুসলমানদের মধ্যে তাঁর মাযহাবের অনুসারী বেশি। ইমাম আবু ইউসুফ (র.), ইমাম মুহাম্মদ (র.), ইমাম যুফার (র.) ও প্রখ্যাত মুহাদ্দিস ইমাম ইবনু মুবারক (র.) প্রমুখ তাঁর শিষ্য ছিলেন।
ইমাম শাফিয়ী (র.) তাঁর সম্পর্কে বলেন, 'মানুষ ফিকাহশাস্ত্রে ইমাম আবু হানিফা (র.)-এর মুখাপেক্ষী।' ব্যক্তি হিসেবে ইমাম আবু হানিফা ছিলেন উঁচুমানের ইবাদতকারী ও মুত্তাকি। কথায় ও কাজে তাঁর অপূর্ব মিল ছিল। তাঁর জীবনে কোনো লোভ-লালসা ছিল না। তিনি অত্যন্ত সহজসরল ও অনাড়ম্বর জীবনযাপন করতেন।

আব্বাসি খলিফা আল মানসুর তাঁকে প্রধান বিচারপতির পদ গ্রহণের প্রস্তাব করেন। তিনি অত্যন্ত দৃঢ়তার সাথে তা প্রত্যাখ্যান করেন। এ কারণে তাঁকে দৈহিক নির্যাতন ও কারাবরণ করতে হয়। তিনি ১৫০ হিজরি ৭৬৭ খ্রিষ্টাব্দে খলিফা আল মানসুর কর্তৃক প্রয়োগকৃত বিষক্রিয়ার ফলে কারাগারেই শাহাদতবরণ করেন।
আমরা ইমাম আবু হানিফা (র.) সম্পর্কে আরও বেশি জানব এবং তাঁর ফিকাহশাস্ত্রের উপর জ্ঞানলাভ করে সুন্দর জীবন গড়ব।

কাজ: শিক্ষার্থীরা শ্রেণিকক্ষে বসে ইমাম আবু হানিফা (র.)-এর ফিকাহশাস্ত্রে জ্ঞানের জনপ্রিয়তা লাভের কারণগুলো চিহ্নিত করবে।
Content added By

হযরত আব্দুল কাদির জিলানি (র.)-এর জীবনাদর্শ (পাঠ ৬)

124

হযরত আব্দুল কাদির জিলানি (র.) ৪৭০ হিজরি মোতাবেক ১০৭৭ খ্রিষ্টাব্দে ইরানের জিলান শহরে জন্মগ্রহণ করেন। জন্মস্থানের নামানুসারে তাঁকে জিলানি বলা হয়। তাঁর উপনাম আবু সালেহ, উপাধি মুহিউদ্দীন, কুতুবে রাব্বানি ইত্যাদি। তাঁর পিতার নাম আবু সালেহ মুসা। তিনি হযরত ফাতিমা (রা.)-এর পুত্র ইমাম হাসান (রা.)-এর বংশধর ছিলেন। তাঁর মাতার নাম উম্মুল খায়ের ফাতিমা। তিনি ইমাম হোসাইন (রা.)- এর বংশধর ছিলেন। এজন্য হযরত আব্দুল কাদির জিলানি (র.)-কে আওলাদে রাসুল বলে গণ্য করা হয়।
এ মহান ওলি বাল্যকাল হতেই শান্ত, নম্র, ভদ্র, চিন্তাশীল ও জ্ঞানানুরাগী ছিলেন। শৈশবে তিনি কুরআন মুখস্থ করেন। জিলানে প্রাথমিক শিক্ষা সমাপ্ত করার পর ১৮ বছর বয়সে উচ্চ শিক্ষা লাভের উদ্দেশ্যে বাগদাদ গমন করেন। নিজামিয়া মাদ্রাসায় তাফসির, হাদিস, ফিকাহ, উসুল, ধর্মতত্ত্ব, তর্কশাস্ত্র, ইতিহাস ও দর্শনে উচ্চ শিক্ষা লাভ করেন।
হযরত আব্দুল কাদির জিলানি (র.) সাধারণ মানুষ থেকে ব্যতিক্রমী একজন মহান সাধক ও তাপস হবেন তা তাঁর শৈশবকালের একটি কাহিনি থেকে বোঝা যায়। বর্ণিত রয়েছে যে, দুগ্ধপোষ্য অবস্থায় তিনি রমযান মাসে দিনের বেলায় মাতৃদুগ্ধ পান থেকে বিরত থাকতেন। তাঁর মা তাকে দুধ পান করাতে গেলে তিনি মুখ ফিরিয়ে নিতেন।
হযরত আব্দুল কাদির জিলানি (র.) শরিয়তের জ্ঞানার্জনের পর মা'রেফাতের (আধ্যাত্মিক) জ্ঞান- লাভের জন্য বাগদাদের সুফি-দরবেশদের দরবারে যাতায়াত শুরু করেন। তাঁর সাথে সাধক হযরত হাম্মাদান (রা.)-এর পরিচয় ঘটে। তিনি তাঁর সাহচর্যেই সুফিতত্ত্বে জ্ঞানলাভ করেন।
হযরত আব্দুল কাদির জিলানি (র.) আধ্যাত্মিক সাধনার জন্য ২৫ বছর লোকচক্ষুর অন্তরালে চলে যান। ৫২১ হিজরির শেষ ভাগে পুনরায় লোকালয়ে ফিরে আসেন এবং দীন প্রচার শুরু করেন।

হযরত আব্দুল কাদির জিলানি (র.)-এর নিকট শিক্ষা লাভের জন্য অসংখ্য আলেম সমবেত হতেন। তিনি বুধবার স্থানীয় ঈদগাহে সকালবেলায় বক্তৃতা করতেন। কিন্তু শ্রোতার সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় ঈদগাহটির আয়তন বৃদ্ধি করা হয় এবং সেখানে একটি মুসাফিরখানাও স্থাপন করা হয়।
জীবনের শেষ দিকে তিনি দিনের বেলায় খুতবা ও ফতোয়া প্রদানে ব্যস্ত থাকতেন। নিষিদ্ধ পাঁচ দিন ব্যতীত সারা বছর রোযা রাখতেন।
তিনি ছিলেন অভাবীদের প্রতি সহানুভূতিশীল। তাঁর ছাত্রজীবনে বাগদাদে অনটন দেখা দেয়। তিনি তার নিকট থাকা স্বর্ণমুদ্রা থেকে অভাবীদেরকে দান করতেন এবং নিজে খেয়ে না খেয়ে জীবন অতিবাহিত করতেন। অসহায়দের প্রতি তাঁর দরদ কেমন ছিল, তা তাঁর কথা থেকে বোঝা যায়। তিনি বলেন, 'আফসোস তোমার নিকট পুরোদিনের খাবার মওজুদ আছে। অথচ তোমার নিকটতম প্রতিবেশী উপবাস থাকছে। তোমার ইমান অসম্পূর্ণ থেকে যাবে যদি তুমি নিজের জন্য যা চাও অন্যের জন্য তা না চাও।'
এ মহান ওলি বড়পীর নামে প্রসিদ্ধ। তিনি ৯০ বছর বয়সে ৫৬১ হিজরি সনের ১১ রবিউস সানি তারিখে ইন্তিকাল করেন। তাঁর মাজার বাগদাদে অবস্থিত। আমরা বড়পীর হযরত আব্দুল কাদির জিলানি (র.)-এর আদর্শে আমাদের জীবন গড়ব, সদা সর্বদা সত্য কথা বলব, অভাবী ও দুস্থদের সাহায্য ও সেবা করব।

কাজ: শিক্ষার্থীরা শ্রেণিকক্ষে হযরত আব্দুল কাদির জিলানি (র.)-এর চরিত্রের মহৎ গুণাবলির একটি তালিকা তৈরি করবে।
Content added By
Promotion
NEW SATT AI এখন আপনাকে সাহায্য করতে পারে।

Are you sure to start over?

Loading...